খ্রিস্টান ধর্মের সত্ত্যতা যাচাই

চারিদিকেই ক্রিসমাস এর আমেজ। এশিয়া মহাদেশের দেশগুলিতে যদিও পশ্চিমা ও ইউরোপীয়দের মতো জাঁকজমক পূর্নভাবে ক্রিসমাসের আয়োজন করা হয়না তারপরও কেউই এই উৎসবের বাইরে থাকেনা। বছরের পর বছর ধরে যীশুর জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর, যা ক্রিসমাস হিসেবে উদযাপন করা হয়। দেশ ভেদে ও চার্চ ভেদে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা জানুয়ারী মাসের বিভিন্ন সময়েও এই জন্মদিন পালন করে থাকে। যদিও যীশুর জন্মদিন সম্পর্কে বিশেষ তথ্য জানা যায় না তবে খ্রিস্টান পণ্ডিতদের দাবি তিনি বসন্ত বা শীতের প্রারম্ভে জন্মগ্রহণ করেন। আর সেই মতে ডিসেম্বর থেকে শুরু করে জানুয়ারীর বিভিন্ন সময়ে সেটা পালিত হয়ে থাকে। যদিও এই যীশু চরিত্রটি নিয়ে ইসলাম ধর্ম ও খ্রিস্টান ধর্ম নানা হাস্যকর ও অযৌক্তিক কেচ্ছা কাহীনি প্রচলিত আছে তারপরেও যীশুর জীবনি নিয়ে দর্শন শাস্ত্রে ও ইতিহাসে বেশ কিছু মতবাদ প্রচলিত আছে।

খ্রিস্টান ধর্মের যীশু খ্রিস্ট বা ইসলাম ধর্মের ঈসা নবী সম্পর্কে অনেক মতবাদের মধ্যে একটি মতবাদ হচ্ছে সে একটা সময় এশিয়া মহাদেশে এসেছিলেন। শুধু তাই নয় সে ভারতবর্ষে এসেছিলো এবং একবার নয় সে ভারতবর্ষে দুইবার এসেছিলো বলে ধারনা করা হয়। এমনকি কিছু খ্রিস্টান পন্ডিতের দাবী যীশুর সমাধি ভারতের কাশ্মীরে অবস্থিত। আনুমানিক ১০০ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ফরাসি সাধু “আইরেনিয়াস” দাবী করেছিলেন ৩৩ বছর বয়সে যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হলেও সে তখন মারা যায়নি বরং জীবিত ছিলো এবং ৫০ বছরেরও বেশি সময় জীবিত ছিলো। ভালো যে সাধু “আইরেনিয়াস” এই কথা ইসলাম ধর্মের কোরান রচনা হবার ৩০০ বছর আগে বলেছিলেন তা না হলে তার এই কথা কোরানের সাথে সম্পুর্ণ সাংঘর্ষিক হবার কারনে হয়তো ইসলাম ধর্ম অনুসারীরা তাকে হত্যা করতো। কারণ ইসলাম ধর্ম মতে যীশুকে হত্যার আগ মুহুর্তে আল্লাহ জীবিত অবস্থায় তাকে বেহেশতে নিয়ে যান। যা ইসলাম ধর্মের ঐশরিক কিতাব আল-কোরানের সূরা নিসার ১৫৭ ও ১৫৮ নাম্বার আয়াতে পরিষ্কার বলা আছে। এখন এই ফরাসি সাধু যদি এই কথা বলে তাহলে কোরানের বানী মিথ্যা ও ভুল প্রমানীত হয়। এই বিষয়ে ১৯৮১ সালে একজন জার্মান লেখক যার নাম “হলগার ক্রেস্টেন” একটি বই লিখেছিলো “যীসুস লিভড ইন ইন্ডিয়া” নামের বই যেখানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

এই কথার সত্যতা যাচাই করে অনেক ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক একসময় তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন এবং হলগার ক্রিস্টেনের লেখা বইয়ের সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। এই সময়ে সমস্ত ইউরোপে এই লেখা কিছুটা সাড়া ফেলেছিলো। এছাড়াও খ্রিস্টান ধর্মের ঐশরিক কিতাব বাইবেল পর্যালোচনা করে পাওয়া যায় যীশুর ১৩ থেকে ৩০ বছর বয়সের কোন কথায় বাইবেলে নেই তাহলে এই ১৭ বছর সে কি করেছিলো এমন প্রশ্নের উত্তরে লেখক “নটোভিচ” ১৯ শতকের শেষ দিকে একটি বই লিখেছিলেন যার নাম “দ্যা আননোন লাইফ অব যীসুস ক্রিস্ট”। লেখক নটোভিচ ছিলেন একজন তথ্যনুসন্ধানী রাশিয়ার সাংবাদিক। তিনি তার এই বইতে যীশুর জীবনের এই ১৭ বছরকে “মিসিং লাইফ অব যীসুস” বলে আখ্যায়িত করেন যেখানে তিনি বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন এই হারানো ১৭ বছরের মধ্যে যীশু রোমান সাম্রাজ্যের বাইরে দুইবার ভারতবর্ষে এসেছিলেন যার একবার তার ক্রুশবিদ্ধ হবার আগে এবং একবার ক্রুশবিদ্ধ হবার পরে। এটা একটি দীর্ঘ আলোচনা হবার কারণে এখানে আর সে বিষয়ে কিছুই লিখবো না তবে পরবর্তিতে জানানোর চেষ্টা করবো।

ঐতিহাসিকভাবে আমরা যীশুর অস্তিত্বের সন্ধান করলে তার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত যে মতবাদ গুলা দেখে থাকি তা হচ্ছে এই যীশুর জীবন শুরু হয়েছিলো বর্তমানে যা উওর ও মধ্য ফিলিস্তিন নামে পরিচিত যায়গাটিতে। উত্তর ও মধ্য ফিলিস্তিন এবং পূর্বে মৃত সাগর (ডেড সী) এবং জর্দান নদী এবং পশ্চিমে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের মাঝখানের একটি অঞ্চলেই এই যীশুর জীবন শুরু হয়েছিলো। বিভিন্ন ধর্মীয় ঐশরিক কিতাব মতেও সেই একই কথা পাওয়া যায়। খ্রিস্টের শুরুতে প্রথম শতাব্দীর সময়ে বা প্রথম শতাব্দীর শুরু থেকে এই অঞ্চলটি রোমানদের নিয়ন্ত্রনাধীন একটি অঞ্চল ছিলো। যদিও রোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন অঞ্চলসমূহ ভূমধ্যসাগরের চারিদিকে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তারও আগে থেকেই তাই এই অঞ্চলটিকে রোমানরা প্রাথমিকভাবে একটি উপজাতীয় রাজ্য বা অঞ্চল হিসেবেই বিবেচনা করতো যে কারনেই যীশুর জন্য তার প্রচার করা কথা মানুষকে বিশ্বাস করাতে সুবিধা হয়েছিলো যদিও পরবর্তিতে তাকে এই কারনেই ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিলো। একটা সময় রোমান সভ্যতায় বিভিন্ন অভ্যন্তরীন সমস্যা দেখা দেয় যার কারনে বিভিন্ন অভিযানের সুত্রপাত করা হয়। এসময় রোমান সভ্যতার অনেক অঞ্চলের মানুষই অভ্যন্তরীন বিদ্রোহের সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং সেই সাথে পার্শিয়ানদের আক্রমনও ঘটে। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩৭ সালের দিকে এই অঞ্চলটিতে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় যখন রোমান সাম্রাজ্যের রাজা ছিলেন “হেরোদ দ্যা গ্রেট”। তার সময় থেকে “জুলিয়াস সিজারের” সময় পর্যন্ত সময়ে এই অঞ্চলটি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা লাভ করে ও সমৃদ্ধি লাভ করে।

রাজা “হেরোদ” ছিলেন ইহুদী ধর্মের অনুসারী তবে অনেকের দাবী তিনি সাম্রাজ্যের স্বার্থে এই ধর্মের বানী মানুষের মাঝে প্রচার করতেন। যীশুকে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরা “যীশু খ্রিস্ট” নামেই জানেন তবে সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে “খ্রিস্ট” কিন্তু যীশুর আসল নাম না। তখনকার সময়ে সন্তানের নামের সাথে তার জন্মদাতা পিতা বা পালক পিতার নাম যোগ করে দেওয়ার নিয়ম চালু ছিলো। যেহেতু যীশুর কোন বায়োলজিক্যাল পিতা ছিলো না বা পৃথিবীর কোন মানুষ তার পিতা না তাই দেবতাদের নামের একটি অংশ যোগ করে তার নামের সাথে “খ্রিস্ট” শব্দটি যোগ করা হয়েছে। এই বিষয়ে খ্রিস্টান ধর্মের ঐশরিক কিতাব বাইবেলের (লূক-Luck ৪,২২) এ বলা আছে “সকলেই তাঁর খুব প্রশংসা করল, তাঁর মুখে অপূর্ব সব কথা শুনে তারা আশ্চর্য হয়ে গেল। তারা বলল, ‘এ কি য়োষেফের ছেলে নয়?” এছাড়াও এই বিষয়ে আরো উল্লেখ আছে বাইবেলের (যোহন-John ১,৪৫ ৬,৪২) তারপরে (বিধান-Act ১০,৩৮) সহ আরও অনেক যায়গাতে। যীশু খিস্ট নামের খ্রিস্ট শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ “ক্রিশোসের” থেকে যা গ্রিকরা তাদের যেকোন শিরোনামে ব্যবহার করে থাকে। এই খ্রিস্ট শব্দের বাংলা অর্থের কিছুটা মিল হচ্ছে “অভিষিক্ত এক” বা “নির্বাচন করা হয়েছে” এমন কিছু যা ইসলাম ধর্মেও প্রচলিত আছে এই যীশুর নামে যেমন “ঈশা মসীহ”। এই মশীহ মানে হচ্ছে ইসলামে আল্লাহ তাকে নির্বাচন করেছেন যা এই খ্রিস্ট শব্দেরই রুপান্তর বলা চলে।
---------- মৃত কালপুরুষ

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.