হুমায়ূন আহমেদ এর জীবনি
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ | |
---|---|
![]()
৫৯তম জন্মদিনে নিজের ঘরে হুমায়ূন আহমেদ
| |
জন্ম | শামসুর রহমান ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ কুতুবপুর গ্রাম, কেন্দুয়া, নেত্রকোনা জেলা, পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) |
মৃত্যু | ১৯ জুলাই ২০১২ (৬৩ বছর)[১] নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র |
সমাধিস্থল | নুহাশ পল্লী |
পেশা |
|
জাতীয়তা | ![]() |
জাতি | বাঙালি |
শিক্ষা |
|
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
সময়কাল | ১৯৭২–২০১২ |
ধরন |
|
বিষয় | রসায়ন , সমসাময়িক জীবন |
উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহ | জোছনা ও জননীর গল্প, নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, দেয়াল, মধ্যাহ্ন |
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | বাংলা একাডেমি পুরস্কার একুশে পদক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার |
দাম্পত্যসঙ্গী | গুলতেকিন খান(বি. ১৯৭৩; বিচ্ছেদ ২০০৩) মেহের আফরোজ শাওন(বি. ২০০৫; মৃত্যু ২০১২) |
সন্তান | নোভা, শীলা আহমেদ, বিপাশা, নুহাশ হুমায়ূন, নিষাদ, নিনিত |
আত্মীয় | মুহম্মদ জাফর ইকবাল (ভাই) আহসান হাবীব (ভাই) সুফিয়া হায়দার (বোন) মমতাজ শহিদ (বোন) রোকসানা আহমেদ (বোন) |
স্বাক্ষর | ![]() |
হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮ – ১৯ জুলাই, ২০১২) বিংশ শতাব্দীর বাঙালিজনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক গণ্য করা হয়। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার,চিত্রনাট্যকার ও চলচিত্রনির্মাতা। বলা হয় আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও তিনি সমাদৃত। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক।[২] বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক। তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত। সত্তর দশকের শেষভাগে থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি তিনি ছিলেন বাংলা গল্প-উপন্যাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কারিগর। এই কালপর্বে তাঁর গল্প-উপন্যাসের জনপ্রিয়তা ছিল তুলনারহিত। তাঁর সৃষ্ট হিমু এবং মিসির আলি ও শুভ্র চরিত্রগুলি বাংলাদেশের যুবকশ্রেণীকে গভীরভাবে উদ্বেলিত করেছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীও তাঁর সৃষ্টিকর্মের অন্তর্গত। ধরা হয় বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনপ্রিয়তা তিনি শুরু করেন। তাঁর রচিত প্রথম সায়েন্স ফিকশন "তোমাদের জন্য ভালোবাসা" তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহ পেয়েছে অসামান্য দর্শকপ্রিয়তা। তবে তাঁর টেলিভিশন নাটকগুলি ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয়। সংখ্যায় বেশী না হলেও তাঁর রচিত গানগুলোও সবিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর অন্যতম উপন্যাস হলো নন্দিত নরকে, মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাতাল হাওয়া',লীলাবতী, কবি ইত্যাদি। তাঁর নির্মিত কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো দুই দুয়ারী, শ্রাবণ মেঘের দিন, ঘেঁটুপুত্র কমলা ইত্যাদি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে দীর্ঘকাল কর্মরত ছিলেন।[৩] লেখালিখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বার্থে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাঁকে আটক করে এবং নির্যাতনের পর হত্যার জন্য গুলি চালায়। তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।[৪]
জীবনী[সম্পাদনা]
প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]
জন্ম ও শৈশব[সম্পাদনা]
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোণা মহুকুমার মোহনগঞ্জে তাঁর মাতামহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।[৫] তাঁর পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা ফয়েজ। তাঁর পিতা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও (উপ-বিভাগীয় পুলিশ অফিসার) হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হন। তার বাবা সাহিত্য অনুরাগী মানুষ ছিলেন। তিনি পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি করতেন। বগুড়া থাকার সময় তিনি একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেছিলেন। গ্রন্থের নাম দ্বীপ নেভা যার ঘরে । তাঁর মা'র লেখালিখির অভ্যাস না-থাকলেও একটি আত্ম জীবনী গ্রন্থ রচনা করেছেন যার নাম জীবন যে রকম । পরিবারে সাহিত্যমনস্ক আবহাওয়ায় ছিল। তাঁর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের একজন বিজ্ঞান শিক্ষক এবং কথাসাহিত্যিক; সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা আহসান হাবীব রম্য সাহিত্যিক এবং কার্টুনিস্ট।[৬] তাঁর তিন বোন হলেন সুফিয়া হায়দার, মমতাজ শহিদ, ও রোকসানা আহমেদ।[৭]
তাঁর রচিত উপন্যাস থেকে জানা যায় যে ছোটকালে হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান; ডাকনাম কাজল। তাঁর পিতা (ফয়জুর রহমান) নিজের নামের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন শামসুর রহমান। পরবর্তীতে আবার তিনি নিজেই ছেলের নাম পরিবর্তন করে হুমায়ূন আহমেদ রাখেন। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, তাঁর পিতা ছেলে-মেয়েদের নাম পরিবর্তন করতে পছন্দ করতেন। তাঁর ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম আগে ছিল বাবুল এবং ছোটবোন সুফিয়ার নাম ছিল শেফালি। ১৯৬২-৬৪ সালে চট্টগ্রামে থাকাকালে হুমায়ুন আহমেদের নাম ছিল বাচ্চু।
শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]
তাঁর বাবা চাকুরী সূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেছেন বিধায় হুমায়ূন আহমেদ দেশের বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিজ্ঞানে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ৫৬৪ নং কক্ষে তার ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন।
১৯৭০-এর দশক[সম্পাদনা]
প্রারম্ভিক কর্মজীবন[সম্পাদনা]
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী তোমাদের জন্য ভালোবাসা রচনা করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় একসময় তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দেন৷ শিক্ষক হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন এই অধ্যাপক৷
সাহিত্যচর্চা শুরু[সম্পাদনা]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনে একটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য জীবনের শুরু। এই উপন্যাসটির নাম নন্দিত নরকে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপন্যাসটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২-এ কবি-সাহিত্যিক আহমদ ছফারউদ্যোগে উপন্যাসটি খান ব্রাদার্স কর্তৃক গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত বাংলা ভাষাশাস্ত্র পণ্ডিত আহমদ শরীফ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দিলে বাংলাদেশের সাহিত্যামোদী মহলে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। শঙ্খনীল কারাগার তাঁর ২য় গ্রন্থ।[৪]
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর রচনার প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো 'গল্প-সমৃদ্ধি'। এছাড়া তিনি অনায়াসে ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে অতিবাস্তব ঘটনাবলীর অবতারণা করেন যাকে একরূপ যাদু বাস্তবতাহিসেবে গণ্য করা যায়। তাঁর গল্প ও উপন্যাস সংলাপপ্রধান। তাঁর বর্ণনা পরিমিত এবং সামান্য পরিসরে কয়েকটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে চরিত্র চিত্রণের অদৃষ্টপূর্ব প্রতিভা তাঁর রয়েছে। যদিও সমাজসচেতনতার অভাব নেই তবু লক্ষ্যণীয় যে তাঁর রচনায় রাজনৈতিক প্রণোদনা অনুপস্থিত। সকল রচনাতেই একটি প্রগাঢ় শুভবোধ ক্রিয়াশীল থাকে; ফলে 'নেতিবাচক' চরিত্রও তাঁর লেখনীতে লাভ করে দরদী রূপায়ণ। এ বিষয়ে তিনি মার্কিন লেখক স্টেইনবেক দ্বারা প্রভাবিত। অনেক রচনার মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির প্রচ্ছাপ লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস মধ্যাহ্ন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরিগণিত। এছাড়া জোছনা ও জননীর গল্প আরেকটি বড় মাপের রচনা, যা কি-না ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বন করে রচিত। তবে সাধারণত তিনি সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে লিখে থাকেন।[৪]
বিবাহ[সম্পাদনা]
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭৬ সালে গুলতেকিন খানকে বিয়ে করেন। গুলতেকিন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর নাতনী।[৮] এই দম্পতির তিন মেয়ে এবং এক ছেলে। তিন মেয়ের নাম বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ এবং ছেলের নাম নুহাশ আহমেদ। অন্য আরেকটি ছেলে অকালে মারা যায়।
১৯৮০-এর দশক[সম্পাদনা]
প্রথম প্রহর ও এইসব দিনরাত্রি[সম্পাদনা]
টেলিভিশন নাট্যকার হিসেবে হুমায়ূন আহমেদকে আবিষ্কার করেন নওয়াজিশ আলি খান। আহমেদের নন্দিত নরকে ও শঙ্খনীল কারাগারপড়ার পর তিনি একদিন ধানমন্ডির দখিন হাওয়াতে রত্নদ্বীপ নাটকের চিত্রায়নকালে খান তাঁর সাথে পরিচিত হন। তিনি আহমেদকে টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখতে আহ্বান জানান। টেলিভিশনের জন্য হুমায়ূন আহমেদের প্রথম কাজ হল টেলিভিশন নাটক প্রথম প্রহর। এটি ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। নাটকটি পরিচালনা করেন নওয়াজিশ আলি খান। মানুষের সততাকে কেন্দ্র করে নির্মিত নাটকটি প্রচারের পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।[৯] পরবর্তীতে খান আহমেদ রচিত অসময়, অযাত্রা, বিবাহ, এসো নিপবনে, নিমফুল নাটক প্রযোজনা করেন।[৯] আহমেদ রচিত প্রথম ধারাবাহিক নাটক এইসব দিনরাত্রি (১৯৮৫)।[১০] নাটকে লিউকোমিয়া আক্রান্ত শিশু চরিত্র 'টুনি'কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আহমেদের কাছে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে দর্শকের প্রচুর চিঠি আসে, কিন্তু আহমেদ তার চিত্রনাট্যে অটল থাকেন।[১১]
বহুব্রীহি ও কোথাও কেউ নেই[সম্পাদনা]
নওয়াজিশ আলি খানের প্রযোজনায় হুমায়ূন আহমেদ রচিত প্রথম টেলিভিশন ধারাবাহিক বহুব্রীহি। এটি ১৯৮৮-৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। ধারবাহিকটির প্রতিটি পর্ব ছিল বিষয়ভিত্তিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, যা ছিল বাংলাদেশের টিভি নাটকের অভিনব ব্যাপার। এই ধারাবাহিকের মাধ্যমে কিছু সামাজিক বিষয়, যেমন - মিথ্যা না বলা ও পুষ্টি সংরক্ষণের জন্য সপ্তাহে এক দিন মাছ না খাওয়া, এবং মুক্তিযুদ্ধকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলে।[৯] ধারাবাহিকের একটি সংলাপ "তুই রাজাকার" বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।[১২] এই সময়ে নির্মিত হয় টেলিভিশন নাটক আয়োময়। এই নাটকেই তাঁর কন্যা শীলা আহমেদের অভিনয়ে অভিষেক হয়। আহমেদ এই নাটকের মহড়া, চিত্রায়ণ ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন, যা তাঁকে পরবর্তীতে পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে।[৯] তাঁর রচিত আরেকটি অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিক হল কোথাও কেউ নেই (১৯৯০)। এই ধারাবাহিকের বাকের ভাই চরিত্রটি তুমুল দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রুখতে দর্শক 'বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে' স্লোগান দিয়ে মিছিল করে। এমনকি, আহমেদের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে দর্শকেরা আক্রমণ করে। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে তিনি রমনা থানায় জিডিও করেছিলেন।[১২]
মিসির আলি চরিত্র[সম্পাদনা]
মিসির আলি চরিত্রটি আহমেদের মাথায় আসে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটার ফার্গো শহরে স্ত্রী গুলতেকিনের সাথে গাড়িতে ভ্রমণকালে। এই ঘটনার অনেকদিন পর তিনি মিসির আলি বিষয়ক প্রথম উপন্যাস দেবী লিখেন।[১৩] ১৯৮৫ সালে উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তিনি এই চরিত্রকে কেন্দ্র করে রচনা করেন নিশীথিনী (১৯৮৭), নিষাদ (১৯৮৮), অন্য ভুবন (১৯৮৯) ও বৃহন্নলা (১৯৮৯)।[১৪]
নুহাশ পল্লী[সম্পাদনা]
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৮৭ সালে ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের পিজুলিয়া গ্রামে ২২ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত বাগান বাড়ি নুহাশ পল্লী গড়ে তুলেন। বাড়িটির নামকরণ করা হয় গুলতেকিন ও তাঁর প্রথম পুত্র নুহাশ হুমায়ূনের নামে। বর্তমানে এর আয়তন আরও বৃদ্ধি করে ৪০ বিঘা করা হয়েছে। এজাজুল ইসলাম তাঁকে এই জমি কেনা ও ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করেন।[১৫] বাড়িটির সর্ব উত্তরে একটি পুকুর রয়েছে। পুকুরটির নাম 'লীলাবতী'। এর নামকরণ করা হয় শাওন ও তাঁর অকালপ্রয়াত কন্যার নামে, যে পৃথিবীর আলো দেখার পূর্বে মৃত্যুবরণ করে। পুকুরে একটি কাঠের পুল রয়েছে। পুকুরের মাঝখানে একটি কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে তাবু পোঁতা আছে।[১৫]
জীবনের শেষ সময়ে তিনি এই বাড়িতে থাকতে ভালোবাসতেন। তিনি বিবরবাসী মানুষ; তবে মজলিশী ছিলেন। গল্প বলতে আর রসিকতা করতে খুব পছন্দ করতেন। তিনি ভণিতাবিহীন ছিলেন। নীরবে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি ও আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করা তার শখ। তবে সাহিত্য পরিমণ্ডলের সঙ্কীর্ণ রাজনীতি বা দলাদলিতে তিনি কখনো নিজেকে জড়িয়ে ফেলেননি। তিনি স্বল্পবাক, কিছুটা লাজুক প্রকৃতির মানুষ এবং বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও অন্তরাল জীবন-যাপনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তবে নিঃসঙ্গতা খুব একটা পছন্দ করতেন না। কোথাও গেলে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে যেতে পছন্দ করতেন। বাংলাদেশে তাঁর প্রভাব তীব্র ও গভীর; এজন্য জাতীয় বিষয়ে ও সঙ্কটে প্রায়ই তাঁর বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমসমূহ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে থাকতো। অতুলনীয় জনপ্রিয়তা সত্বেও তিনি অন্তরাল জীবন-যাপন করেন এবং লেখালেখি ও চিত্রনির্মাণের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন।
১৯৯০-এর দশক[সম্পাদনা]
হিমু ও শুভ্র চরিত্র[সম্পাদনা]
হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট হিমু চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে ময়ূরাক্ষী উপন্যাস দিয়ে। ১৯৯০ সালে মে মাসে অনন্যা থেকে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে চরিত্রটি পাঠকদের, বিশেষ করে, তরুণ সাহিত্যপ্রেমীদের, মাঝে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে একে একে প্রকাশিত হতে থাকে দরজার ওপাশে (১৯৯২), হিমু (১৯৯৩), পারপার (১৯৯৪), এবং হিমু (১৯৯৫), হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম(১৯৯৬), হিমুর দ্বিতীয় প্রহর (১৯৯৭), হিমুর রূপালী রাত্রি (১৯৯৮), এবং একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁঝিঁপোকা (১৯৯৯)। এছাড়া এই উপন্যাসসমূহ নিয়ে হিমু সমগ্র (১৯৯৪), হিমু সমগ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) (১৯৯৮), এবং হিমু অমনিবাস (২০০০) প্রকাশিত হয়।[১৬]
শুভ্র চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে দারুচিনি দ্বীপ উপন্যাস দিয়ে। বইটি অনুপম প্রকাশনী থেকে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয়। শুভ্রকে নিয়ে রচিত তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস হল মেঘের ছায়া। এটি ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়। দারুচিনি দ্বীপ উপন্যাসের গল্পের শেষ থেকে শুরু হয় পরবর্তী উপন্যাস রূপালী দ্বীপ (১৯৯৪)।[১৭]
শঙ্খনীল কারাগার ও আগুনের পরশমণি[সম্পাদনা]
১৯৯২ সালে হুমায়ূন আহমেদ রচিত শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাস অবলম্বনে মোস্তাফিজুর রহমান একই নামের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। মুক্তির পর চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মধ্যে ছবিটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ চারটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারলাভ করে। ১৯৯৪ সালে আগুনের পরশমণি চলচ্চিত্র দিয়ে তাঁর পরিচালনায় অভিষেক হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক চমৎকার গল্প ও দুর্দান্ত নির্মাণশৈলী দিয়ে তিনি দর্শকের মন জয় করেন এবং চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারলাভ করে।[১৮]
শ্রাবণ মেঘের দিন ও গীত রচনা[সম্পাদনা]
১৯৯৯ সালে তিনি নির্মাণ করেন লোক-নাট্যধর্মী শ্রাবণ মেঘের দিন। এটি তাঁর নিজের রচিত একই নামের উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ। চলচ্চিত্রটি সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে এবং ২০০২ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অধিভুক্ত সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনের করা জরিপে সমালোচকদের বিচারে এটি সেরা দশ বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের তালিকায় নবম স্থান অধিকার করে।[১৯] এছাড়া ছবিটি সাতটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। হুমায়ূন আহমেদ মূলতঃ গান রচয়িতা বা গীতিকার নন। কেবল নাটক ও চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে তিনি গান রচনা করে থাকেন। এই চলচ্চিত্রের জন্য তাঁর রচিত "একটা ছিল সোনার কন্যা" গানটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এই গানে কণ্ঠ দিয়ে গায়ক সুবীর নন্দী শ্রেষ্ঠ পুরুষ কণ্ঠশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।[১৮]
২০০০-এর দশক[সম্পাদনা]
২০০১ সালে দুই দুয়ারী চলচ্চিত্র দুটি প্রথম শ্রেনীর দর্শকদের কাছে দারুন গ্রহণযোগ্যতা পায়। ২০০৩-এ নির্মাণ করেন চন্দ্রকথা নামে একটি চলচ্চিত্র। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রটি। এটি ২০০৬ সালে "সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র" বিভাগে একাডেমি পুরস্কার এর জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল।[২০] এছাড়াও চলচ্চিত্রটি কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়।[২১]
বিচ্ছেদ ও দ্বিতীয় বিবাহ[সম্পাদনা]
১৯৯০ সালের মধ্যভাগ থেকে তার কন্যা শীলার বান্ধবী এবং তার বেশ কিছু নাটক-চলচ্চিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী শাওনের সাথে হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। এর ফলে সৃষ্ট পারিবারিক অশান্তির অবসানকল্পে ২০০৩ সালে গুলতেকিনের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয় এবং ঐ বছরই শাওনকে বিয়ে করেন।[২২] এ ঘরে তাদের তিন ছেলে-মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রথম ভূমিষ্ঠ কন্যাটি মারা যায়। ছেলেদের নাম নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন।
এছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে ২০০৬ সালে মোরশেদুল ইসলামপরিচালিত দুরত্ব, বেলাল আহমেদ পরিচালিত নন্দিত নরকে এবং আবু সাইয়ীদ পরিচালিত নিরন্তর। ২০০৭-এ শাহ আলম কিরণ পরিচালিত সাজঘর এবং তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র দারুচিনি দ্বীপ। ২০০৮-এ আমার আছে জল চলচ্চিত্রটি তিনি পরিচালনা করেন।[২৩]
২০১০-এর দশক[সম্পাদনা]
ঘেটুপুত্র কমলা[সম্পাদনা]
ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২) তাঁর পরিচালিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি ৮৫তম একাডেমি পুরস্কারে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগের জন্য বাংলাদেশ থেকে নিবেদন করা হয়েছিল।[২৪]
ক্যান্সার ও মৃত্যু[সম্পাদনা]
জীবনের শেষভাগে ঢাকা শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডির ৩/এ রোডে নির্মিত দখিন হাওয়া ভবনের একটি ফ্লাটে তিনি বসবাস করতেন। খুব ভোর বেলা ওঠা অভ্যাস ছিল তাঁর, ভোর থেকে সকাল ১০-১১ অবধি লিখতেন তিনি। মাটিতে বসে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। কখনো অবসর পেলে ছবি আঁকতেন। ২০১১-এর সেপ্টেম্বের মাসে সিঙ্গাপুরেডাক্তারী চিকিৎসার সময় তাঁর দেহে মলাশয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। তিনি নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোয়ান-কেটরিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। তবে টিউমার বাইরে ছড়িয়ে না-পড়ায় সহজে তাঁর চিকিৎসা প্রাথমিকভাবে সম্ভব হলেও অল্প সময়ের মাঝেই তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১২ দফায় তাঁকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর তাঁর কিছুটা শারীরিক উন্নতি হলেও, শেষ মুহূর্তে শরীরে অজ্ঞাত ভাইরাস আক্রমণ করায় তার অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যায়। কৃত্রিমভাবে লাইভ সাপোর্টে রাখার পর ১৯ জুলাই ২০১২ তারিখে হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন। মলাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০১২ সালের ১৯ জুলাই-এ স্থানীয় সময় ১১:২০ মিনিটে নিউ ইয়র্কের বেলেভ্যু হসপিটালে এই নন্দিত লেখক মৃত্যুবরণ করেন।[২৫] তাকে নুহাশ পল্লীতেদাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে সারা বাংলাদেশে সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব আহাজারির সৃষ্টি হয়। তাঁর মৃত্যুর ফলে বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র অঙ্গনে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়।
দর্শক ও সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া[সম্পাদনা]
নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস হুমায়ূন আহমেদের সামগ্রিক প্রভাব মূল্যায়ন করে বলেন, "হুমায়ূনের কাজসমূহ সাহিত্যে ঠাকুর [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর] ও নজরুলে [কাজী নজরুল ইসলাম] পরে সবচেয়ে গভীর ভাবসম্পন্ন ও সবচেয়ে ফলপ্রসূ।"[২৬] একই রকমভাবে, বাংলাদেশী কবি আল মাহমুদ তাঁর সম্পর্কে বলেন, "ঠাকুর ও নজরুলের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের একটি স্বর্ণযুগ শেষ হয়েছে এবং আরেকটি শুরু হয়েছে আহমেদের মধ্য দিয়ে।"[২৬] বাংলাদেশী লেখক ইমদাদুল হক মিলন তাঁকে "বাংলা সাহিত্যের সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকারী" বলে উল্লেখ করেন, যিনি তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের সকল কাজ ও চিন্তা-ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করেন।"[২৬] বাঙালি লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়তাঁকে "বাংলা সাহিত্যে একটি শতাব্দীর সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক" উল্লেখ করেন,[২৭] এবং তার মতে "আহমেদ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধায়েরচেয়েও জনপ্রিয় ছিলেন।"[২৮] বাঙালি লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁকে "উপমহাদেশের অন্যতম সেরা লেখক" বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশী লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, "তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন।" পাকিস্তানের প্রাচীনতম ও সর্বাধিক পঠিত ইংরেজি সংবাদপত্র ডন তাঁকে "বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কিংবদন্তি" বলে উল্লেখ করেন।[২৯]
উত্তরাধিকার[সম্পাদনা]
শ্রদ্ধাঞ্জলি[সম্পাদনা]
এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিনের যৌথ উদ্যোগে হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রতি বছর আহমেদের জন্মদিনে ১২ নভেম্বর দুজন সাহিত্যিককে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়।[৩০]
অনুপ্রেরণা[সম্পাদনা]
হুমায়ূন আহমেদের তুমুল জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিক কোথাও কেউ নেই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাতা রেদওয়ান রনি নির্মাণ করেন সাত পর্বের একটি মিনি-ধারাবাহিক বাকের ভাই, হিমু। এর গল্প শুরু হয় কোথাও কেউ নেই-এর পর থেকে, যেখানে হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র হিমু মুনাকে কথা দেয় সে বাকের ভাইকে খুঁজে বের করবে। ঘটনাপ্রবাহে একদিন সত্যি সত্যি বাকের ভাইয়ের সাথে দেখা হয় হিমুর। ধারাবাহিকটি ২০১০ সালের ঈদুল ফিতরে দেশ টিভিতে প্রচারিত হয়।[৩১]
সাহিত্যকর্ম[সম্পাদনা]
চলচ্চিত্রের তালিকা[সম্পাদনা]
বাংলা চলচ্চিত্রে হুমায়ুন আহমেদ একাধারে চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক। তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র গুলো হলো
চলচিত্রের নাম | মুক্তির সাল | ভূমিকা | টীকা |
---|---|---|---|
শঙ্খনীল কারাগার | ১৯৯২ | চিত্রনাট্যকার | মুস্তাফিজুর রহমান পরিচালিত বিজয়ী: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার |
আগুনের পরশমণি | ১৯৯৪ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | বিজয়ী: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ প্রযোজক, কাহিনীকার, ও সংলাপ রচয়িতা |
শ্রাবণ মেঘের দিন | ১৯৯৯ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | |
দুই দুয়ারী | ২০০০ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | |
চন্দ্রকথা | ২০০৩ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | |
শ্যামল ছায়া | ২০০৪ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | ৮৬তম অস্কার প্রতিযোগীতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে |
দূরত্ব | ২০০৬ | চিত্রনাট্যকার | মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত |
নন্দিত নরকে | ২০০৬ | চিত্রনাট্যকার | বেলাল আহমেদ পরিচালিত |
নিরন্তর | ২০০৬ | চিত্রনাট্যকার | আবু সাইয়ীদ পরিচালিত |
নয় নম্বর বিপদ সংকেত | ২০০৬ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | |
দারুচিনি দ্বীপ | ২০০৭ | চিত্রনাট্যকার | তৌকির আহমেদ পরিচালিত বিজয়ী: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার |
সাজঘর | ২০০৭ | চিত্রনাট্যকার | শাহ আলম কিরণ পরিচালিত |
আমার আছে জল | ২০০৮ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | |
প্রিয়তমেষু | ২০০৯ | চিত্রনাট্যকার | মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত |
ঘেটু পুত্র কমলা | ২০১২ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | বিজয়ী: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার |
অনিল বাগচীর একদিন(মরণোত্তর) | ২০১৫ | চিত্রনাট্য | মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত। |
কৃষ্ণপক্ষ | ২০১৬ | শাওন পরিচালিত |
টেলিভিশন[সম্পাদনা]
তিনি ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য টেলিভিশন ধারাবাহিক এবং টেলিফিল্ম রচনা শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে তার প্রথম টিভি কাহিনীচিত্র প্রথম প্রহর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এটি তাঁকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে।
তাঁর অন্যতম টেলিভিশন ধারাবাহিক -
- এইসব দিনরাত্রি
- বহুব্রীহি
- কোথাও কেউ নেই
- নক্ষত্রের রাত
- অয়োময়
- আজ রবিবার
- নিমফুল
- তারা তিনজন
- আমরা তিনজন
- মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম
- সবুজ সাথী
- উড়ে যায় বকপঙ্খী
- এই মেঘ এই রৌদ্র
পরবর্তি সময়ে তিনি বহু এক পর্বের নাটক নির্মাণ করেছেন। যাদের মধ্যে খেলা, অচিন বৃক্ষ, খাদক, একি কান্ড, একদিন হঠাৎ, অন্যভুবনউল্লেখযোগ্য।[৩২]
পুরস্কার ও সম্মাননা[সম্পাদনা]
হুমায়ুন আহমেদ তাঁর অসংখ্য বহুমাত্রিক সৃষ্টির জন্য নানা পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলা কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৩ সালে লেখক শিবির পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা উপন্যাসে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি মাইকেল মধুসুদন পদক লাভ করেন। ১৯৯০ সালে তিনি হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া তিনি জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক লাভ করেন।
১৯৯২ সালের শঙ্খনীল কারাগার চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে তাঁর প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।[৩৩]বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দেশের দ্বিতীয় বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।[৩৪] একই বছরের আগুনের পরশমণি চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা বিভাগে তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।[৩৩] শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও শ্রেষ্ঠ গীতিকার বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন।[১৮] এছাড়া চলচ্চিত্রটি সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনের জরিপে সমালোচকদের বিচারে সেরা দশ বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের তালিকায় নবম স্থান লাভ করে।[১৯]
তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে তৌকির আহমেদ নির্মিত দারুচিনি দ্বীপ (২০০৭) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।[৩৫] আমার আছে জল (২০০৮) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ১১তম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে সমালোচক পুরস্কার শাখায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক বিভাগে মনোনয়ন লাভ করেন। তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম নির্মিত প্রিয়তমেষু(২০০৯) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন।[১৮] ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক এবং শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।[৩৬] এই চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ১৫তম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে সমালোচক পুরস্কার শাখায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম নির্মিত অনিল বাগচীর একদিন (২০১৫) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ৪০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে মরণোত্তর শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার পুরস্কার লাভ করেন।[৩৭]
No comments