যৌন শিক্ষা মানে শারীরিক সম্পর্কের হাতে কলমে শিক্ষা নয়!

পাঠ্যপুস্তকে যৌন স্বাস্থ্যের বিষয়টি ইতিমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করেছে বাংলাদেশ সরকার৷ কিন্তু যৌন শিক্ষা পড়ানো নিয়ে সমস্যা হচ্ছে৷ শিক্ষকরা এতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি, ছাত্র-ছাত্রীরাও বিষয়টিকে সহজভাবে নিচ্ছে না৷
যৌন শিক্ষা নিয়ে তরুনরা কি ভাবছে, এ বিষয়ে ডয়েচেভেলে অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। যাদের প্রায় সবারই বক্তব্য এমন যে, নারী-পুরুষের শারীরিক মিলন সম্পর্কে জ্ঞানকেই যৌন শিক্ষা বলে৷
আরেকজন বলেছেন, যৌন শিক্ষা হলো যৌন মিলনের উপর জ্ঞান, আরেকজন বলেছেন, যৌন শিক্ষা জীবনের জৈবিক চাহিদা সম্পর্কে জানা এবং যৌনতার সঠিক প্রয়োগ ও সতর্কতাকে বোঝায়। আরেকজন তো প্রাক্টিক্যাল ব্যাপার স্যপার উল্লেখ করেছেন, যৌন শিক্ষা হলো শারীরিক সম্পর্কের হাতে কলমে শিক্ষা।
যৌন শিক্ষা নিয়ে তরুনরা কি ভাবছে, এ বিষয়ে ডয়েচেভেলে অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। যাদের প্রায় সবারই বক্তব্য এমন যে, নারী-পুরুষের শারীরিক মিলন সম্পর্কে জ্ঞানকেই যৌন শিক্ষা বলে৷
আরেকজন বলেছেন, যৌন শিক্ষা হলো যৌন মিলনের উপর জ্ঞান, আরেকজন বলেছেন, যৌন শিক্ষা জীবনের জৈবিক চাহিদা সম্পর্কে জানা এবং যৌনতার সঠিক প্রয়োগ ও সতর্কতাকে বোঝায়। আরেকজন তো প্রাক্টিক্যাল ব্যাপার স্যপার উল্লেখ করেছেন, যৌন শিক্ষা হলো শারীরিক সম্পর্কের হাতে কলমে শিক্ষা।
নারে ভাই ও বোনেরা, যৌন শিক্ষা মানে কিভাবে সেক্স করবেন তা হাতে কলমে শেখানো নয়! যৌন শিক্ষা স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত। কিশোরীর বয়ঃসন্ধীকালীন শারীরিক পরিবর্তন, মানসিক পরিবর্তন, যৌনতা নিয়ে ভ্রান্ত ধারনা, পিরিয়ডকালীন পরিচ্ছন্নতা সবই পড়ে।
কাউকে ছোট করে বলছি না ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া স্টুডেন্টদের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে জোর দিয়ে বলতে হয় যৌন শিক্ষা আমাদের জন্য কতটা প্রয়োজন। পাঠ্যপুস্তকে এই শিক্ষার অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে অনেকের নাক সিটকানি আছে। কিন্তু বন্ধু বান্ধবের সাথে আলাপে, কিংবা ওয়েবসাইট ঘেটে তরুনরা মুলত যৌনতা সম্পর্কে যে জ্ঞান লাভ করে সেটা আসলে পর্নগ্রাফি দেখা, যৌণ শিক্ষা নয়।
সাক্ষাৎকার দেয়া একজন মন্তব্য করেছেন, ‘যৌন শিক্ষা আগে থেকে জানার কিছু নেই, নেই ভালো কোনো দিক৷ যখন এ বিষয়ে জানার প্রয়োজন হবে তখন এমনিতেই তা জানা যাবে।’
বিষয়টা এমন না যে নারী পুরুষ বন্ধ ঘরে আসলো, এরপর কি করতে হবে তা কাউকে শিখিয়ে দিতে হবে না! এটা যৌন শিক্ষা নয়, বরং না জানার কারনে পিরিয়ড হবার কারনে যে মেয়েটিকে তার পরিবার ঘরে বন্ধ করে রাখে, কোনো কিছু ছুতে দেয়না, সেই পরিবারকে সচেতন করার দরকার আছে। যে কিশোর যৌনতা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা নিয়ে আজীবন ভয়ের মধ্যে দিননিপাত করে তাদের জন্য এই শিক্ষার প্রয়োজন আছে।
যৌন শব্দটা আমাদের মধ্যবিত্ত মানুষদের মধ্যে এমনিতেই একটা নেতিবাচক আলোড়ন তৈরি করে। এর প্রথম এবং প্রধান কারণ হল বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের ভ্রান্তধারনা। আমরা যৌন সম্পর্কিত বিষয় এর উল্লেখ হলেই মনে করি যৌন কার্যক্রম সংক্রান্ত বিষয়। কিন্তু এটা মটেই ঠিক নয়। যৌন শিক্ষা হল বিষয়ভিত্তিক নির্দেশনা যা কিনা মানুষের যৌনতার (human sexuality) সাথে সম্পর্কিত। এটা আরও আলোচনা করে সেক্সচুয়াল এনাটমি(sexual anatomy), প্রজননতন্ত্র(sexual reproduction), যৌন কার্যক্রম(sexual activity), প্রজনন স্বাস্থ্য(reproductive health),আবেগিক সম্পর্ক(emotional relations), প্রজনন সংক্রান্ত অধিকার ও দায়িত্ব(reproductive rights and responsibilities), যৌন সম্পর্ক তৈরি করা থেকে বিরত থাকা (abstinence) এবং জন্ম নিয়ন্ত্রন(birth control) নিয়ে।
এগারো-বারো বছর বয়সের পর থেকেই ছেলে-মেয়ে সবারই যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ে জানা দরকার৷ এটা না থাকায় অনেকেই ভুল ধারণা নিয়ে বড় হয়, যা তাদের পরবর্তী জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে৷ তাই এই শিক্ষা স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য খুবই প্রয়োজন৷ এই সময়টা বয়ঃসন্ধিকাল, অর্থাৎ কিশোর-কিশোরী থেকে নারী ও পুরুষ হয়ে ওঠার সময়৷ এই বয়স থেকে সাধারণত মেয়েদের ‘পিরিয়ড’ বা ‘মাসিক’ শুরু হয়৷ পাশাপাশি শরীর এবং মনে ঘটতে থাকে নানা পরিবর্তন৷
শরীর মনের এই পরিবর্তনে তাদের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়৷ তারা এই পরিবর্তন নিয়ে তুলনা করে হতাশায় ভুগতে পারে৷ কিন্তু বিষয়টি যদি তাদের কাছে পরিষ্কার থাকে৷ তারা যদি জানে যে এটা স্বাভাবিক পরিবর্তন, তাহলে তাদের মধ্যে কোনো সংকোচ থাকবে না৷ তারা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে৷
বাংলাদেশে মেয়েরা তাদের এই পরিবর্তনের খানিকটা ধারণা হয়ত পায় বড় বোন বা বান্ধবীদের কাছ থেকে৷ তাও অতি গোপনে, লুকিয়ে যেন বাড়ির বড়রা তা জানতে বা বুঝতে না পারে৷ ফলে মেয়েরা অধিকাংশক্ষেত্রে মাসিক সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পায় না৷ না বাড়িতে, না স্কুলে৷ ভাবটা এমন যেন ব্যাপারগুলো বিয়ে হলেই জানবে, আগে জানবার প্রয়োজন নেই৷ মনে রাখতে হবে, যৌন শিক্ষা মানে যৌনতা নয়৷ যৌন শিক্ষা আমাদের স্বাস্থ্য এবং স্বাভাবিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশে মেয়েরা তাদের এই পরিবর্তনের খানিকটা ধারণা হয়ত পায় বড় বোন বা বান্ধবীদের কাছ থেকে৷ তাও অতি গোপনে, লুকিয়ে যেন বাড়ির বড়রা তা জানতে বা বুঝতে না পারে৷ ফলে মেয়েরা অধিকাংশক্ষেত্রে মাসিক সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পায় না৷ না বাড়িতে, না স্কুলে৷ ভাবটা এমন যেন ব্যাপারগুলো বিয়ে হলেই জানবে, আগে জানবার প্রয়োজন নেই৷ মনে রাখতে হবে, যৌন শিক্ষা মানে যৌনতা নয়৷ যৌন শিক্ষা আমাদের স্বাস্থ্য এবং স্বাভাবিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য।
জার্মানিতে প্রাথমিক পর্যায়েই যৌন শিক্ষা, অর্থাৎ যৌনতা সম্পর্কে খোলাখুলিভাবে জানানো হয়৷ যৌন সম্পর্ক কী?, কম বয়সে যৌনতার ক্ষতিকর দিক, জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, গর্ভধারন, গর্ভপাত এবং অবশ্যই যৌনরোগ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করা হয় স্কুলেই৷ নিজের শরীর সম্পর্কেও সচেতন করে দেয়া হয় তাদের৷ ফলে কোনটা ভালোবাসার স্পর্শ আর কোনটি অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে – সেটা তারা সহজেই বুঝতে পারে৷ যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের মতো কোন পরিস্থিতে করণীয় কী – সেটাও তাদের বোঝানো হয়৷
ব্রিটেনের প্রাইমারি স্কুলগুলোতে যৌন শিক্ষা বাধ্যতামুলক করা হয়েছে। সরকারী স্কুলগুলোর পাঁচ থেকে ১৬ বছর বয়সী ছাত্র ছাত্রীরা শিক্ষকদের কাছ থেকে যৌনতার নানা দিক নিয়ে গঠনমুলক শিক্ষা পাচ্ছে৷এর পাশাপাশি মাদকের ভয়াবহতা, অনিরাপদ গর্ভধারণ ও সুস্বাস্থ্য রক্ষায় বিভিন্ন নিয়মকানুন সম্পর্কেও শিক্ষা দেয়া হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের৷
এ বিষয়ে ব্রিটিশ স্কুল শিক্ষামন্ত্রী জিম নাইটের বক্তব্য, ব্রিটিশ ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করে তোলা আমাদের কর্তব্য হয়ে দাড়িয়েছে৷ বেশির ভাগ কিশোরকিশোরীরা যৌনতার ব্যাপারে তাদের বন্ধুদের কাছ থেকে নয়তো বিভিন্ন জায়গা থেকে ভুল তথ্য পেয়ে থাকে৷ এটা রোধ করা খুবই জরুরি৷
ভারত সরকার যৌন শিক্ষাকে সরকারী স্কুলের পাঠ্যক্রমের আওতায় আনতে নারাজ৷ বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ স্কুলে যৌনশিক্ষা প্রবর্তনের ঘোর বিরোধী৷ তারা মনে করে, যৌনশিক্ষা ছেলেমেদের মনের উপর বিরূপ প্রভাব রাখবে৷ ২০০৭ সালে তাঁর অনুসারীরা গর্ভধারণ ও যৌনরোগের মত বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এমন সব স্কুল বই পুড়িয়ে দেয়৷ গুজরাট রাজ্য বিজ্ঞানের টেক্সট বই থেকে প্রজনন সংক্রান্ত অধ্যায় বাদ দিতে বাধ্য হয়৷
কিন্তু ভারতে কিশোরীদের মধ্যে গর্ভপাত সংক্রান্ত যে সরকারি তথ্য পাওয়া গেছে, তা চমকে দেবার মতো৷মুম্বই শহরে ১৫ বছরের কম বয়সি মেয়েদের মধ্যে গর্ভপাতের প্রবণতা ৬৭ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ আর তাইতো সচেতন সকল মহলে জোর দাবি উঠেছে।
মুসলিম প্রধান দেশ মালয়েশিয়ায় ২০১৪ সালে ২৬টি শিশুকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে।এখানকার স্কুলগুলোতে ২০১১ সাল থেকে যৌনশিক্ষা চালু করার কথা থাকলেও সম্প্রতি তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুলের বাইরে যৌন শিক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অল্পবয়েসিদের মধ্যে অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ, সদ্যোজাত শিশুকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে রাখা – এ সব রুখতেই এই ব্যবস্থা৷ এমনকি ইরানেও স্বল্প প্ররসরে যৌনশিক্ষার পাঠদান শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে যৌন শিক্ষা চালুর পর থেকে নানান ধরনের অপঃপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে মৌলবাদিরা।বিশাল একটা মহল ‘স্কুলে শিক্ষার্থীদের মাঝে যৌন সুড়সুড়ি বিষয়ক বই বিতরণ হচ্ছে’ বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে! হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) গবেষণা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী ও সেক্রটারী জেনারেল মাওলানা হাফেজ আবু তাহের যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছেন, অশ্লীল ব্লুফিল্ম দেখিয়ে যৌণ শিক্ষার মাধ্যমে সুকৌশলে শিশুদের চরিত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে। সব আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে। যৌন শিক্ষা মূলক পাঠ্যপুস্তক বাতিল করে সম্পাদক প্রনেতাদের গ্রেফতার ও বিচার করার আহবান জানিয়েছেন।
আমাদের দেশে যৌন-সম্পর্কিত বিষয় এতবেশিস সামাজিক, ধর্মীয় এমনকি পারিবারিক কুসংস্কার ও নিষেধের বেড়াজালে ঘেরা যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেউ ছেলেমেয়েদের মানসিক, আচরণীয় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এ বিষয়কে আমলে আনেন না। কিন্তু যৌনসংক্রান্ত বিষয়ে যৌবনাগমনের আগেই পারিবারিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশে আলোচনা এবং পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়ের স্পষ্ট উপস্থিতি শিশু থেকে শুরু করে বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়ের অযাচিত আচরন থেকে রক্ষা করবে।
No comments